Friday, October 26, 2012

সংসদে ক্যাট ফাইটের উপক্রম এবং বিশ্বের অন্যন্য দেশের আইনসভার সত্যিকারের ফাইট



গত কিছুদিন ধরে জাতীয় সংসদে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের সম্মানিত সাংসদদের মধ্য বাকবিতণ্ডা দেখা যাচ্ছে এবং এমনকি কিছুদিন আগে খনিকটা ক্যাট ফাইটেরও মঞ্চায়ন হয়েছিল যদিও চুলো চুলি হবার আগেই উপস্থিত অন্যান্য মাননীয় গণদের সরাসরি হস্তক্ষেপে তা ক্ষেপণ হয়। টিভিতে দেখা তাইওয়ান এবং কোরিয়ার পার্লামেন্টের মারপিটের কথা মনে পরে গেল। তা নিয়ে সামান্য ঘাটা ঘাটি করতে গিয়ে বুঝলাম আসলে আমরা অনেক অনেক “ভদ্র” অন্তত এই ৪১ বছরের বাংলাদেশের আইনসভায় কখনো সহিংসতা হয়নি, যা হয়েছে সব রাজপথে হয়েছে। ওই রাজপথের মারপিট পার্লামেন্টে হলে বেশকিছু সাধারণ মানুষের প্রাণ বাঁচত।

বিশ্বের অনেক দেশের আইনসভায় মারপিটের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্য সবচাইতে বি/কুখ্যাত গুলো সামান্য শেয়ার করতে ইচ্ছে হল। মজার ব্যাপার হচ্ছে আইনসভা মারপিটে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ সমান। মারপিটের মূল কুশীলবদের বেশিরভাগ সময় শাস্তি হয়নি কিংবা খুবই লঘু দন্ড হয়েছে।

ব্রিটেন যুক্তরাজ্য: আধুনিক পার্লামেন্টের সূতিকাগার হিসেবে সবার মনে প্রাথমিক ভাবে ব্রিটেনের নাম চলে আসে। তবে সত্যি কথা বলতে কি মহামান্য রানীর এই ঐতিহাসিক পার্লামেন্টের বিতর্কের ভঙ্গি আমার কাছে কৌতুকর মনে হয় এবং বিনা নোটিশে সদস্যদের হঠাৎ হঠাৎ দাড়িয়ে যাওয়া আমায় ছোট কালের ফিশিং গেমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মাঝখানে যায়গা খালি রেখে দুই দিকে দুই দলের প্যারালাল বসা নাকি তাদের মাঝে মারপিট বন্ধ করার উদ্দেশ্যই করা হয়েছে কেননা আগের দিনে এমপিদের ব্যক্তিগত অস্ত্র বহন করায় বাধা ছিলনা।
১৯৭২ সালে এক মহিলা এমপি বারনার্ড ডেভলিন তৎকালীন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে গুশি মারেন যার ফলশ্রুতিতে তে তাঁকে ৬ মাসের জন্য আইনসভায় অনাকাংক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৭৬ এক এমপি আইনসভার প্রতীক দণ্ড জোড় করে নিয়ে মাথার উপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সরকারী দলকে উপহাস করছিলেন। অন্য এক সদস্য তাঁকে নিবৃত করেন এবং সেদিন এই ঘটনার জন্য অধিবেশন মুলতবি ঘোষিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্র - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সকল অযাচিত আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করা হয় যদিও সেখানে উভয় কক্ষে মারপিট নিয়মিত বিরতিতে হয়ে আসছে সেই স্বাধীনতার পর হতে। ১৭৯৮ কংগ্রেসের এক সদস্য আরেক সদস্যকে কে ছড়ি দিয়ে আঘাত করেন এবং এর আগেও তাদের হাতাহাতির ঘটনা ছিল । ১৮৫৬ সালে দক্ষিণ ক্যারোলিনার কংগ্রেসম্যান প্রেস্টন ব্রুক্স এবং লরেন্স কেট ম্যাসাচুসেটসের চার্লস সামার এর উপর পাড়ার মাস্তানের মত আক্রমণ করেন, সামারের এক বক্তব্যর প্রেক্ষিতে। তাকে ধাতব ডিব্বা দিয়ে মেরে মারাত্মকভাবে আহত করেন ব্রুক্স । লরেন্স কেট পরের বার ১৮৫৮ সালে আবার একই কাণ্ড করেন । এক সদস্যের বক্তব্যর প্রেক্ষিতে তার গলা টিপে ধরেন কেট । কিছুক্ষণ পরে দুইজনের পক্ষবলম্বন করে প্রায় ৫০ সদস্যদের মধ্য মারপিট লেগে যায়। ১৯০২ আবার দক্ষিণ ক্যারোলিনার সদস্য মারপিট বাধিয়ে দেন; এবার সিনেটে এবং নিজেদের মধ্য। সিনেটর বেঙ্গামিন টিল্ম্যান তার রাজ্যর অপর সিনেটর জন ম্যাক্ল্রিঙ্কে আক্রমণ করেন এর ফলে মারপিট লেগে যায় এবং সিনেট মুলতবি হয়।
সমসাময়িক কালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় সহিংসতা তেমন একটা না হলেও বিভিন্ন রাজ্যর স্থানীয় আইনসভায় মারপিট নিয়মিত ঘটনা এরমধ্য অ্যালাব্যামা, ইন্ডিয়ানা এবং ক্যালিফোর্নিয়া উল্লেখযোগ্য।

দক্ষিণ কোরিয়া - আধুনিক গণতন্ত্রের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া নিঃসন্দেহে মডেল। সামরিক একনায়কতন্ত্রের ইতি ঘটার পর থেকে এর গণতন্ত্র দিনে দিনে সমৃদ্ধ হতে থাকে শুধু কয়েকটি অতি-বিশাল দুর্নীতি এবং আইনসভায় কতগুলো মারপিটের ঘটনা বাদ দিলে। ২০০৪ সালে দুর্নীতিদায়ে অভিযুক্তর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রো-মূ-হিউনের অভিশংসন করার বিশেষ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির সমর্থকদের সাথে বিরোধিপক্ষের সদস্যদের সাথে হাতাহাতি লেগে যায় যা যেকোনো স্কুলের মারপিটকে হার মানাবে। ২০০৯ এবং ২০১০ সালে বিল পাশ করাকে কেন্দ্র করে সরকারী দলের সদস্যদের সাথে বিরোধী পক্ষের তুমুল মারপিট লেগে যায় ।

তাইওয়ান - তাইওয়ানের গণতন্ত্রও প্রশংসনীয় তবে সমসাময়িক কালে তাদের আইনসভার মারপিট অন্যসব দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। ওটা সেখানে নিয়মিত ঘটনা। ২০০৪ সালে বিভিন্ন মাসে প্রায় তিনবার সরকার এবং বিরোধী দলের সদস্যদের মাঝে হাতাহাতি হয়। ২০০৬ সালে সরকারি দলের সদস্য ওয়াং সু হি বিরোধী দলের এক প্রস্তাবের লিখিত কাগজের কপি ছো মেরে নিয়ে মুখে নিয়ে নেন। বিরোধীদলের সদস্যরা তার চুল টেনে ধরে তার সাথে চুলো-চুলি করেও তা বের করতে পারেনি, কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তিনি নিজে মুখ থেকে তা বের করে ছিড়ে ফেলেন। ২০০৭ সালে বিলম্বিত বাজেট ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সদস্যদের মধ্য ফ্রি-স্টাইল মারপিট হয় যেমন আমাদের দেশে রাজপথে হয়। কয়েক জনকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল আহত হয়ে।

জাপান - জাপান এক ডার্ক হর্স। গড়পড়তায় জাপানিরা জাতি হিসেবে খুবই ভদ্র এতে কেউ অস্বীকার করবেনা কিন্তু তারা তাদের পার্লামেন্টে ওটা ধরে রাখতে পারেননা। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম বারের মত গভীর সাগরে সশস্ত্র নৌ সেনা পাঠানোর উপর সদস্য ইউকিসা ফুজিটা প্রশ্ন তোলেন এর পরপরই সরকারী এবং বিরোধী দলের মধ্য হাতাহাতি। আরেকবার এক সদস্য তার জুডো কেরামতি দিয়ে অপর দুজন সদস্যকে একসাথে কুপোকাত করেন। প্রায়ই জাপানে এমন ঘটে।

ইটালি - বিশ্বের সবচাইতে নাটকীয় পার্লামেন্টের মধ্য ইটালির পার্লামেন্ট শীর্ষে এটা কেউ অস্বীকার করবেননা। ২০১১ সালে অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দুজনের মারপিট। মূল কুশীলব ক্লদিও বারবারও এবং ফ্যাবিও রেনেরি।

রাশিয়া - ২০০৫ সালে রাশিয়ান পলিটিক্সের ব্যাড বয় ভ্লাদিমির জিরনভস্কি অপর সদস্য আন্দ্রেয় সাভেলেভ কে আক্রমণ করেন এবং মারপিট করেন। এরপরে এবং আগে আরও কয়েকবার মারপিট হয় যাতে বিভিন্ন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। তবে সবচাইতে বড় সহিংসতা বোধয় দেশের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক হয়েছিল, ইয়ালতসিন আক্ষরিক আর্থেই আংশিকভাবে রাশিয়ার পার্লামেন্ট ভবন “হোয়াইট হাউস” ভেঙ্গে দিয়েছিলেন ট্যাঙ্কের গোলা দিয়ে।

ইউক্রেন - ২০১০ রাশিয়াকে নৌ ঘাটি লিজ দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সময় দুই পক্ষে লড়াই। ডিম এবং পটকা ছোড়া-ছুড়ি ফলশ্রুতিতে স্পিকারের পলায়ন এবং আইনসভা অঘোষিত ভাবে স্বয়ংক্রিয় ভাবে মুলতবি।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট - ১৯৮৮ সালে পার্লামেন্টের ভেতর প্রাত্যহিক বিভিন্ন দৈনন্দিন ব্যবহার্য অফিস সামগ্রী ছোড়া-ছুড়ি।

মেক্সিকো - ২০০৬ সালে মেক্সিকোর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আইনসভায় সদস্যদের মধ্য মারপিট লেগে যায়।


চেক প্রজাতন্ত্র -২০০৬ সালে এক সদস্য (যিনি সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী) তার ভাষ্যমতে “একান্ত ব্যক্তিগত” (স্ত্রী বিষয়ক) কারণে তৎকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে আঘাত করেন। যদিও তা পার্লামেন্টের বাইরে হয়েছিল এক চিকিৎসক সম্মেলনে।

বলিভিয়া - ২০০৭ সালে কোর্টের জজ দের দুর্নীতি তদন্ত বিষয়ক আলোচনায় দু পক্ষের মধ্য মারপিট।
ইসরায়েল - ২০০৯ গাজায় বসতি স্থাপন বিষয়ক বিতর্কে দু পক্ষের মারপিট।

নাইজেরিয়া - ২০০৭ সালে সরকারি গাড়ি ক্রয়ের তদন্তকে কেন্দ্র করে দু পক্ষে তুমুল মারপিট।

ভেনেজুয়েলা – ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজের সমর্থক এক সদস্যের সাথে বিরোধী এক সদস্যর হাতাহাতি

জর্জিয়া - ২০০৫ সালে কুস্তীগিরের সমর্থনে রাস্তায় প্রতিবাদ বিষয়ক আলোচনাকে কেন্দ্র করে দু পক্ষের মারপিট।

সুরিনাম - ২০০৭ সালে দু সদস্যর মধ্য হাতাহাতি।

শ্রীলঙ্কা - ২০১১ সালে বাজেট পেশের দিন সরকারী এবং বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্য ঘুষাঘুষি এবং বোতল ছোড়া-ছুড়ি।

ভারত - ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভায় মারপিট হয়নি কিন্তু প্রাদেশিক আইনসভা মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ১৯৮৯ এবং উত্তর প্রদেশ ১৯৯১ সালে হয়েছিল। উত্তর প্রদেশের এসেম্বলিতে মারপিট ছিল একটা এপিক। আইন সভার ভেতর সংঘটিত ওটা সম্ভবত বিশ্বের সবচাইতে বড় সহিংসতা। প্রায় সব সদস্য ওটাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশাল হলের এমন কিছু বাকি ছিলনা যা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি, এমনকি মাইক পর্যন্ত খুলে ওটা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে আজ পর্জন্ত সর্ববৃহৎ আইনসভার সহিংসতা হয়েছিল।

বিবিসির খবর - আইনসভায় সহিংসতা নিয়ে]

নিউ ইয়র্ক টাইমস এর ব্লগ

ইউ টিউব ভিডিও - সংক্ষেপে

ভিডিও - সবচাইতে ভয়াবহ ১৭ টি

উইকিপিডিয়ার আর্টিকেল - আইনসভায় সহিংসতা

সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে:

প্রথম আলো - দুই সাংসদের মধ্য ক্যাট ফাইটের উপক্রম

সংসদ মার্চ ১৮, ২০১২ - আলোচ্য ভিডিও




----------------------------------------XXXXX------------------------------------------------

 প্রবন্ধটি ২১ শে মার্চ, ২০১২ সালে সমহোয়্যার ইন ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল।
 

No comments:

Post a Comment