Wednesday, December 05, 2012

মুক্তচিন্তা কিংবা মুক্তমনের সীমাবদ্ধতা



সবকিছুতেই ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক দিক আছে। মানব সমাজ জন্ম থেকে কতগুলো সামাজিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়:

১।নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
২।ধর্ম
৩।ভাষা
৪।সামাজিক সংস্কৃতি
৫।রাজনৈতিক জাতীয়তা

মানুষ সামাজিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য আশ্রয় খোঁজে। মানুষের বেঁচে থাকা শুধু খাদ্য অন্বেষণে সীমাবদ্ধ নয়।

উপরোক্ত পাঁচটি বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করা মানুষের জন্য খুব সহজ নয়। কেননা এর প্রাপ্তি তার বুদ্ধি হবার আগ থেকেই হয়, তার মননে গেঁথে যায়।

পাঁচটি বিষয় নিয়ে তাৎক্ষনিক কিছু প্রশ্ন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই শুধু ঋণাত্মক গুলো মুক্তমনে করা যাক
 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক বাহিনী এবং তাদের দোসরদের অত্যাচারের কথা প্রায় সবাই জানেন। কিন্তু ঐ সময়ে এবং যুদ্ধের ঠিক পরে, অনেক জায়গায় বাঙালীদেরও পাল্টা অত্যাচার হয়েছিল এবং যুদ্ধে মাঝে মাঝে শিশু সৈনিক ব্যবহারের কথা শোনা যায় এবং শিশু দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের কতগুলো অন্যতম সফল আক্রমণ করা হয়েছিল…… এখন স্বাধীন দেশে এটা কে আলোচনা করবে???? করবেনা, ওটা বিদেশীরা করবে অথবা খুব বেশি হলে একাডেমিক আলোচনা হবে…… কিন্তু কখনই পাবলিক নয়। এটাই হওয়া উচিৎ। অনেকে আমাকে জামাত বলে গালি দিতে পারেন এই কথা বলার পর। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এসব আমার গায়ে লাগেনা, কেননা কেউ কিছু বললে তেমন কিছু আসে যায়না কারণ মানুষের মুখের কথায় উত্তেজিত হওয়া সবচাইতে বোকামি। পার্শবর্তী দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তান সাম্রাজ্য বিরোধী মানবতার কথা বললেও তারা নিজেরা আরও বেশি সাম্রাজ্যবাদীতার পরিচয় দিচ্ছে, কাশ্মীর, আসাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, সিকিম কিংবা বেলুচিস্তান এসব শুধু চেনাগুলো। আরও অনেককিছুই আছে। আসলে, সব কথার শেষ কথা, রাজনৈতিক ভাবে যারা জয়ী হয়, ইতিহাস তাদেরই গুণগান করে। এই বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস রচনা হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। তাদের অনেক নেগেটিভ সাইটো পজেটিভ ভাবে দেখানোর চেষ্টা করবেন ইতিহাস লেখকগণ।

পশ্চিমা সাদারা, ভারতীয়দের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক সময় বর্ণবাদী আচরণ করত। গান্ধীকে এক সময় ট্রেনের বগি হতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, গায়ের রং সাদা না হবার জন্য। আচ্ছা অনেক দক্ষিণ এশীয়রা নিজেরা কি কম বর্ণবাদী। বাঙ্গালীরা বাদামী কিংবা একটু গাড় বাদামী। এই কোয়েজি/সেমি ডার্ক স্কিন নিয়েও বাঙ্গালীরা, পারফেক্ট ডার্ক স্কিনের মানুষদের সুযোগ পেলেই টিটকারি মারে…… মারেনা??? ভারতে দলিত শ্রেণীর কথা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের অনেক মানুষই মনে করে আফ্রিকা মানে জঙ্গল!!!!!! তারা অসভ্যঅনেকের ধারনাই নাই আফ্রিকার অনেক দেশ বাংলাদেশ হতে অনেক উন্নত এবং মিশর-ইথিওপিয়া বাদেও ওখানে আরও অনেক প্রাচীন সাবসাহারান সভ্য রাষ্ট্র ছিল। চাকমারা দাবী করে তারা বাঙালীদের দ্বারা পাল্টা বিভিন্ন দিক হতে জাতিগত অত্যাচারের স্বীকার; আবার অনেক চাকমাদের দ্বারা মারমারা বিভিন্নভাবে নিগৃহীত।

আমরা আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু যেসব নিয়ে আসলেই গর্ব ওসব নিয়ে করা হয়না। গর্ব করা হয় উনবিংশ শতাব্দীতে কলোনিয়াল আমলে যেসব সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে। ফোক এখনো আমাদের খেটে খাওয়া গণমানুষের বিনোদন। অনেকে আবার ট্র্যাডিশনাল বাদ্যযন্ত্র বাদ দিয়ে গিটার দিয়ে ফোক গান গেয়ে খাটি বাঙ্গালী হবার চেষ্টা করেন, দোতারা নিয়েযে ব্যাভেরিয়ান-ভেগাবন্ড স্মার্টনেস ভাব তাদের আসেনা !!!!! অনেকে আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং মরমী সঙ্গীতকে বিনোদনের মাধ্যম থেকে সরিয়ে ধর্মের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। একটু ফিউশনই গেল গেল রব তোলেন যেন সাংস্কৃতিক চরমপন্থা। আবার এক শ্রেণীর মানুষ বাসায় পরিবার সহ বসে চিকনি চামেলি নাচন আর ক্যাটরিনার কোমর দোলান দেখে, কিন্তু বাংলা সিনেমা অশ্লীলতা জন্য দেখেননা…… বিচিত্র হিপোক্রেসি।
 
বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। অনেকে অতি আবেগে বলে ফেলেন এটা কয়েক হাজার বছরের পুরোন ভাষা। এর বিরোধিতা অনেকে হজম করতে পারেনা। বিরোধিতা করলেই তাকে ধার্মিক জাতীয়তাবাদী বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে হাজার-দের হাজার বছর আগে বাংলা ভাষার ল্যাঙ্গুয়েজেনেসিস হয়নি। যেমন ইংরেজি কিংবা হিন্দি হয়নি। তবে চীনা ম্যান্ডারিন কিংবা ল্যাটিন, সংস্কৃত পালি ব্যতিক্রম।
 
আচ্ছা জাতি হিসেবে কি আমরা ঐ পাকিস্তানি পাঞ্জাবি চিন্তা ভাবনা থেকে খুব বেশি দূরে।যুদ্ধের পর স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা শেখ মুজিব পার্ব্যত্য চট্টগ্রামের অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে বাঙ্গালী হয়ে যেতে বলেছিলেন, আমার মনে হয় এই কথা জিন্নাহর সেই ৫২র বক্ত্যব্য থেকেও থেকেও নীচ চিন্তা, উর্দু তো জিন্নাহর নিজের মাতৃভাষা ছিলনা কিন্তু শেখ মুজিবের নিজের মাতৃভাষা বাংলা ছিল!!!!
বাংলাদেশ শান্তি প্রিয় মোডারেটমুসলিম এবং বাঙ্গালী সংখ্যা প্রধান দেশ। তবে দেশের ১৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম না এবং ২ শতাংশ মানুষ বাঙ্গালী না। আমাদের দেশে রাষ্ট্র ধর্ম আছে আবার রাষ্ট্র ভাষাও আছে। যারা এই সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রীয় বিশেষণে বিশেষায়িত বিশেষ্যর বিরোধিতা করেন তারাও সব কিছুর বিরোধিতা করেননা। বেশিরভাগের রাষ্ট্র ধর্মে চুলকানি থাকলেও রাষ্ট্র ভাষা তে নেই। কোনটির করেন কোনটির করেননা।

সহজ কথায়, যারা ধর্ম পালন করেননা কিংবা ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন তাদের নাস্তিক বলা হয়। সমাজে যেমন ধর্ম কিংবা জাতিসত্তা ভিত্তিক চরমপন্থি আছে তেমন নাস্তিক চরমপন্থিও আছে।
 
অনেক প্রগতিশীল গে-লেসবিয়ান বিয়ের অধিকারের ব্যাপারে কথা বলেন তারাই নিজেরা বহুবিবাহের ব্যাপারে উদারতার পরিচয় দেননা। আবার যারা পলিগেমির সমর্থক, তাদের মধ্য বেশিরভাগ পলিযিনি সমর্থন করে কিন্তু পলিএনড্রির ঘোর বিরোধী। পৃথিবীতে স্ট্রেট এর পাশাপাশি লেসবিয়ান-গে আছে আবার হেটারো আছে যারা কোন কিছুর ধার ধারেনা। অনেকে আবার অর্গি-গ্রুপেও মজা পায়। গ্রুপ ম্যারেজের উদাহরণও দেখা যায়, আমি কিছুদিন আগে এক ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে এটা নিয়ে ফিচার দেখেছি। এখন এই ইন্টারনেটের যুগে আমরা সহজে জানতে পারি জুফিলিয়া-নেক্রোফিলিয়া নামেও শব্দ আছে; আচ্ছা এরা যদি দাবী করে ইন্টারস্পিসিস ম্যারেজ আইন সম্মত করার!!!!! এদের প্রায় সবাই মনে করে পেডোফিলিয়া অপরাধ কিন্তু এর ঘোর বিরোধী যদিও ফ্রেন্স সরকার আবার এক পেডোফিল রোমান পোলানেস্কি কে বিচারের হাত থেকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক চেষ্টার ত্রুটির বিচুতি করেনা। ফ্রেঞ্চরা আবার নিজেদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প বোদ্ধা দাবী করে কিনা, এজন্য বোধয় পেডফিলিক কর্মকান্ডে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত এক শিল্পীকে বাঁচানোর এই প্রয়াস!!
এখন আবার পরিবেশ বাদী চরমপন্থাও চোখে পরে!!!!! আমার সবচাইতে হাসি লাগে যখন কেউ প্রাণী মাংস খায়না এই যুক্তিতে যে, এটা খাওয়া মানে প্রকৃতি বিরোধী প্রাণের হত্যা। তারা নাকি ভেজ বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র খুব সফলভাবে দেখিয়েছেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এটা সু-প্রতিষ্ঠিত। মূল ব্যাপার হওয়া উচিৎ, অপ্রয়োজনীয় নিধন করা অনুচিত, সেটা প্রাণী হোক কিংবা উদ্ভিদ হউক।

এসবের মত

ধর্মও একটা ফ্যাক্টর। পৃথিবীর কোন ধর্মই মানবতা বিরোধী কথা বলেনা। কিন্ত যুগে যুগে মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করেছে, নিজের সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে স্বার্থ আদায় করার সব ধর্মেই চরমপন্থী আছে, খৃস্টান, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জুডাইজম সহ সব ধর্মেই। আবার এসব ধর্মের ভেতরেও অনেক ফ্যাকশন আছে, যারা একজন আরেকজনকে স্বীকৃত দিতে অনিচ্ছুক।

যাই হোক, আমার বলার উদ্দেশ্য যে যতই নিজেকে মুক্তমনা দাবী করুক। পৃথিবীতে কেউই শতভাগ মুক্তমনা নয়। সব বাদ দিয়ে শতভাগ মুক্তমনা হলে সমাজ বলে আর কিছু থাকবেনা যার ফলাফল নৈরাজ্য। যেমন গণতন্ত্রের মাঝেও কিছু নিয়মতান্ত্রিকতা থাকতে হয় তানাহলে নৈরাজ্য শুরু হয়ে যায়।
সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হলে সহমর্মিতা সবার আগে প্রয়োজন। কি দরকার অপরের বিশ্বাসকে ভার্বালি অফেন্স করে তাকে কষ্ট দেওয়া যদি না তা কোন ক্ষতির কারণ হয়ে না দাড়ায়।
 
শেষ কথা, সকল প্রকার চরমপন্থা নিন্দনীয়। কোন কিছু আদায় করতে হলে সিস্টেমেটিক ভাবে আগানোই শ্রেয়। মানুষ জন্ম সুত্রে যা পায়, তা থেকে পরবর্তীতে বের হয়ে আসা এত সোজা নয়।

               -------------------X-------------------

 প্রবন্ধটি ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালে চতুর্মাত্রিক ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল 

No comments:

Post a Comment