Sunday, June 24, 2012

চর্যাপদ - বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন (চর্যাপদের উপর প্রাথমিকতথ্য…… পোষ্টটি বাংলা ভাষাতত্ত্ব - সাহিত্যর ছাত্র, পেশাজীবি এবং সংস্কৃতি উদ্যমীগণের জন্য নয় )

[চর্যাপদ - ১, রাগ-পটমঞ্জরী]
(লুইপাদানাম)
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল।।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিণাম।
... .........লুই ভণই গুরু পুছিঅ জাণ।।
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতে নিচিত মরিঅই।।
এড়িঅই ছাঁদ বান্ধ করণ কপ্টের আস।
সূনু পথে ভিড়ি লাহু কররে পাস।।
ভণই লুই আমহে ঝাণে দীঠা।
ধ্মণ চবণ বেণী পিন্ডী বইঠা।।

----------------------------------------------------------------------------
**************************************************
----------------------------------------------------------------------------
প্রথম প্রদীপ: চর্যাপদ
ড. হুমায়ুন আজাদ

বাঙলা ভাষার প্রথম বইটির নাম বেশ সুদূর রহস্যময়। বইটির নাম চর্যাপদ। বইটির আরো কতকগুলো নাম আছে। কেউ বলেন এর নাম চর্য্যাচর্য্যাবিনিশ্চয়, আবার কেউ বলেন এর নাম চর্য্যাশ্চর্য্যাবিনিশ্চয়। বড়ো বিদঘুটে খটমটে এ-নামগুলো। তাই এটিকে আজকাল যে মনোরকম নাম ধরে ডাকা হয়, তা হচ্ছে চর্যাপদ। বেশ সহজ সুন্দর এ নাম। বইটির কথা বিশ শতকের গোড়ার দিকেও কেউ জানতো না। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ। পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী ওই বছর যান নেপালে। নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে আবিস্কার করে তিনি নিয়ে আসেন কয়েকটি অপরিচিত বই। এ-বইগুলোর একটি হচ্ছে চর্যাপদ। চর্যাপদ-এর সাথে আরো দুটি বই- ডাকার্ণব ও দোহাকোষ, যেগুলোকে তিনি নেপারের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে চর্যাপদ-এর সাথেই আবিষ্কার করেছিলেন- মিলিয়ে একসাথে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা (১৩২৩) নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এ-বই বেরোনোর সাথে সাথে সারা দেশে সাড়া পড়ে যায়, সবাই বাঙলা ভাষার আদি নমুনা দেখে বিস্মিত চকিত বিহ্বল হয়ে পড়ে। শুরু হয় একে নিয়ে আলোচনা অর আলোচনা। বাঙালি পণ্ডিতেরা চর্যাপদকে দাবি করেন বাঙলা বলে। কিন্তু এগিয়ে আসেন অন্যান্য ভাষার পণ্ডিতেরা। অসমীয়া পণ্ডিতেরা দাবি করেন একে অসমীয়া ভাষা বলে, ওড়িয়া পণ্ডিতেরা দাবি করেন একে ওড়িয়া বলে। মৈথিলিরা দাবি করেন একে মৈথিলি ভাষার আদিরূপ বলে, হিন্দিভাষীরা দাবি করেন একে হিন্দি ভাষার আদিরূপ বলে। একে নিয়ে সুন্দর কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।

এগিয়ে আসেন বাঙলার সেরা পণ্ডিতেরা। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ইংরেজিতে একটি ভয়াবহ বিশাল বই লিখেন বাঙলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ (১৯২৬) নামে, এবং প্রমাণ করেন চর্যাপদ আর কারো নয়, বাঙালির। চর্যাপদ-এর ভাষা বাঙলা। আসেন ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর সুকুমার সেন, ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্ত। তাঁরা ভাষা, বিষয়বস্তু প্রভৃতি আলোচনা করে প্রমাণ করেন চর্যাপদ বাঙলা ভাষায় রচিত; এটি আমাদের প্রথম বই। চর্যাপদ জ্বলে ওঠে বাঙলা ভাষার প্রথম প্রদীপের মতো, আলো দিতে থাকে আমাদের দিকে, আর আমরা সে-আলোতে পথ দেখে দেখে হাজার বছরের পথ হেঁটে আসি। সত্যিই আজ বিশশতকের শেষাংশে দাঁড়িয়ে এ বইয়ের দিকে তাকালে একে প্রদীপ না বলে থাকা যায় না। এ প্রদীপের শিখা অনির্বাণ। জ্বলে চিরকালের উদ্দেশে।

চর্যাপদ কতকগুলো পদ বা কবিতা বা গানের সংকলন। এতে আছে ৪৬টি পূর্ণ কবিতা, এবং একটি ছেঁড়া খণ্ডিত কবিতা। তাই এতে কবিতা রয়েছে সাড়ে ছেচল্লিশটি। এ-কবিতাগুলো লিখেছিলেন ২৪ জন বৌদ্ধ বাউল কবি, যাঁদের ঘর ছিলো না, বাড়ি ছিলো না; যাঁরা ঘর চান নি, বাড়ি চান নি। সমাজের নিচুতলার অধিবাসী ছিলেন আমাদের ভাষার প্রথম কবিকুল। তাঁদের নামগুলোও কেমন কেমন; নাম যে এমন হতে পারে, তা তাঁদের নামগুলো শোনার আগে ভাবতেও পারা যায় না। কিছু নাম: কাহ্নপাদ, লুইপাদ, সরহপাদ, চাটিল্লপাদ, ডোম্বিপাদ, ঢেন্টণপাদ, শবরপাদ। সবার নামের শেষে আছে 'পাদ' শব্দটি। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন কাহ্নপাদ। কাহ্নপাদের অন্য নাম কৃষ্ণাচার্য। তাঁর লেখা কবিতা পাওয়া গেছে বারোটি। ভুসুকুপাদ লিখেছেন ছটি কবিতা, সরহপাদ লিখেছেন চারটি, কুক্কুরিপাদ তিনটি; লুইপাদ, শান্তিপাদ, শবরপাদ লিখেছেন দুটি করে কবিতা, বাকি সবাই লিখেছেন একটি করে কবিতা।

এ কবিতাগুলো সহজে পড়ে বোঝা যায় না; এর ভাষা বুঝতে কষ্ট হয়, ভাব বুঝতে হিমশিম খেতে হয়। কবিরা আসলে কবিতার জন্যে কবিতা রচনা করেন নি; এজন্যেই এতো অসুবিধা, পদে পদে পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা। আমাদের প্রথম কবিরা ছিলেন গৃহহীন বৌদ্ধ বাউল সাধক। তাঁদের সংসার ছিলো না। তাঁরা সাধনা করতেন গোপন তত্ত্বের। সে তত্ত্বগুলো তাঁরা কবিতায় গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে একমাত্র সাধক ছাড়া আর কেউ তাঁদের কথা বুঝতে না পারে। তাই যখন প্রাচীন ভাষাটি বেশ রপ্ত করে পড়তে যাই চর্যাপদ, দেখি এর কথাবার্তাগুলো কেমন হেঁয়ালির মতো। একবার মনে হয় বুঝতে পারছি, পরমুহূর্তে মনে হয় কিছু বুঝছি না। চর্যাপদ পড়ার মানে হলো চমৎকার ধাঁধার ভেতরে প্রবেশ করা। কিন্তু এ-কবিতাগুলোতে শুধু ধর্মের কথাই নেই, আছে ভালো কবিতার স্বাদ। আছে সেকালের বাঙলার সমাজের ছবি, আর ছবিগুলো এতো জীবন্ত যে মনে হয় এইমাত্র প্রাচীন বাঙলার গাছপালা, আর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটু হেঁটে এলাম। আছে গরিব মানুষের বেদনার কথা, রয়েছে সুখের উল্লাস। বর যাচ্ছে বিয়ে করতে তার ছবি আছে, গম্ভীরভাবে গভীর নদী বয়ে যাচ্ছে তার চিত্র রয়েছে, ফুল ফুটে আকাশ ঢেকে ফেলেছে তার দৃশ্য আছে, পাশা খেলছে লোকেরা তার বর্ণনা আছে। একটি কবিতায় এক দুঃখী কবি তাঁর সংসারের অভাবের ছবি এতো মর্মস্পর্শী করে এঁকেছেন যে পড়তে পড়তে শিউরে উঠতে হয়। কবির ভাষা তুলে দিচ্ছি:

টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।

ঘাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।

বেঙ্গ সংসার বড়হিল জাঅ।
দুহিল দুধ কি বেন্টে ষামায়।



কবি বলেছেন, টিলার ওপরে আমার ঘর, আমার কোনো প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে আমার ভাত নেই, আমি প্রতিদিন উপোস থাকি। বেঙের মতো প্রতিদিন সংসার আমার বেড়ে চলছে, যে-দুধ দোহানো হয়েছে তা আবার ফিরে যাচ্ছে গাভীর বাঁটে। বেশ করুণ দুঃখের ছবি এটি। কবি যে খুব দরিদ্র শুধু তাই নয়, তাঁর ভাগ্যটি বেশ খারাপ। তাই বলেছেন, দোহানো দুধ ফিরে যাচ্ছে আবার গাভীর বাঁটে। এরকম বেদনার কথা অনেক আছে চর্যাপদ-এ, আছে সমাজের উঁচুশ্রেণীর লোকের অত্যাচারের ছবি। তাই কবিরা সুযোগ পেলেই উপহাস করেছেন ওই সব লোকদের। আজকাল শ্রেণীসংগ্রামের কথা বেশ বলা হয়; শ্রেণীসংগ্রামের জন্যে রচিত হয় সাহিত্য। বাঙলা সাহিত্যে শ্রেণীসংগ্রামের সূচনা হয়েছিলো প্রথম কবিতাগুচ্ছেই। এ- কবিতাগুলোতে আছে অনেক সুন্দর সুন্দর উপমা; আছে মনোহর কথা, যা সত্যিকার কবি না হলে কেউ বলতে পারে না। একজন কবি একটি জিনিস সম্বন্ধে বলেছেন, সে জিনিসটি জলে যেমন চাঁদের প্রতিবিম্ব পড়ে, তার মতো সত্যও নয়, আবার মিথ্যেও নয়। এশ্ছরকম চমৎকার কথা অনেক পরে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ 'সাধারণ মেয়ে' নামক একটি বিখ্যাত কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'হীরে বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবু কি সত্য নয়?' সোনায় বানানো হীরেবসানো ফুলতো আর সত্যিকার ফুল নয়, ওটা হচ্ছে বানানো মিছে ফুল। ও ফুল বাগানে ফোটে না, তবু আমরা তাকে ফুল বলি। আরো একজন কবি, যাঁর নাম মম্বলাম্বরপাদ, তাঁর ধনসম্পদের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন:

সোণে ভরিতী করুণা নাবী।
রূপা থুই নাহিক ঠাবী।।



কবি বলেছেন, আমার করুণা নামের নৌকো সোনায় সোনায় ভরে গেছে। সেখানে আর রুপো রাখার মতো তিল পরিমাণে জায়গা নেই। একথা পড়ার সাথে সাথে মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা 'সোনার তরী'র সেই পংক্তিগুলো, যেখানে কবি বলেছেন, 'ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।' এক কবি বলছেন, হরিণের মাংসের জন্যে হরিণ সকরের শত্রু; আরেকজন বলছেন, শরীরটি হচ্ছে একটি বৃক্ষ পাঁচটি তার ডাল। সবচেয়ে ভালো কবিতাটি লিখেছেন কবি শবরীপাদ। তিনি আনন্দের যে- ছবি এঁকেছেন তা তুলনাহীন। কবি হৃদয়ের সুখে বিভোর হয়ে আছেন, যেমন মানুষ থাকে স্বপ্নে। তাঁর কিছু পংক্তি তুলে দিচ্ছি:

উষ্ণা উষ্ণা পাবত তর্হি বসই সবরী বালী।

মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরীমালী।

উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহাড়া তোহোরি।

ণিঅ ঘরিণী নামে সহজ সুন্দরী।
ণাণা তরুবর মৌলির রে গলণত লাগেলী ডালী।।


এর কথাগুলো যেমন সুন্দর, তেমনি মনমাতানো এর ছন্দ। কবি নিজের রূপসী স্ত্রী নিয়ে মহাসুখে আছেন। বলছেন, উঁচু উঁচু যেখানে পাহাড় সেখানে বাস করে শবরী বালিকা। তার পরিধানে ময়ূরের বহুবর্ণ পুচ্ছ, গলায় আছে গুঞ্জা ফুলের মালা। তারপর কবি নিজের উদ্দেশে বলছেন, হে অস্থির পাগল শবর, তুমি গোল বাঁধিও না, এ তোমার স্ত্রী, এর নাম সহজসুন্দরী। শেষ যে- পংক্তিটি তুলে এনেছি তাতো আনন্দের এবং প্রকৃতি বর্ণনার অনিন্দ্য উদাহরণ। বলছেন, অসংখ্য গাছে মুকুল ধরেছে, আর আকাশে ফুর মুকুল আর শাখাপুঞ্জ নড়ে ওঠে। আমরা আবেগে কবি হয়ে ওঠি। চর্যাপদ-এর সবগুলো কবিতা ছন্দে রচিত, পংক্তির শেষে আছে মিল। এগুলো আসলে গান, তাই কবিরা প্রতিটি কবিতার শুরুতে কোন সুরে কবিতাটি গাওয়া হবে, তার উল্লেখ করেছেন। এমন কয়েকটি সুর বা রাগের নাম: রাগ পটমঞ্জরী, রাগ অরু, রাগ ভৈরবী। বাঙলা কবিতায় ১৮০০ সালের আগে যা কিছু রচিত হয়েছে, সবই রচিত হয়েছে গাওয়ার উদ্দেশ্যে। আজকাল আমরা কবিতা পড়ি, গাই না। আগে কবিরা কবিতা গাইতেন, পাঠকেরা শুনতো কবির চারদিকে বসে। মাইকেল মুধুসূধন দত্ত যে- দিন কবিতা লিখলেন সে দিন থেকে কবিতা হয়ে উঠলো পড়ার বস্তু, গাওয়ার নয়। চর্যাপদ-মর কবিতাগুলো গাওয়া হতো। তাই এগুলো একই সাথে গান ও কবিতা। বাঙালির প্রথম গৌরব এগুলো।

----------------------------------------------------------------------------
**************************************************
----------------------------------------------------------------------------

[চর্যাপদ - ৫০, রাগ-রামক্রী]
(শবরপাদানাম)

গঅণত গঅণত তইলা বাড়ী হিএঁ কুরাড়ী।
কন্ঠে নইরামণি বালি জাগন্তে উপাড়ী।।
... ... ছাড় ছাড় মাআ মোহা বিসমে দুন্দোলী।
মহাসুহে বিলসন্তি সবরো লইআ সূণ মেহেলী।।
হেরি সো মোরি তইলা বাড়ী খসমে সমতুলা।
সুকল এ মোরে কপাসু ফুটিলা।।
তইলা বাড়ী পাসেঁ রে জোহ্না বাড়ী তা এলা।
ফিটেলী আন্ধারি রে আকাস ফুলিলা।।
কঙ্গুচিনা পাকেলা রে সবরাসবরি মাতেলা।
অণুদিণ সবরো কিম্পি ণ চেবই মহাসুহেঁ ভোলা।।
চারিবাঁসে গরিলারে দিআঁ চঞ্চালী।
তহিঁ তোলি সবরো ডাহ কএলা কান্দই সন্ডণ সিআলী।।
মারিঅ ভবমত্তা রে দহ দিহে দিধলি বলী।
হের সে সবরো নিরেবণ ভইলা, ফিটিলি সবরালী।।

----------------------------------------------------------------------------
**************************************************
----------------------------------------------------------------------------
অসাধারন কিছু লিঙ্ক-

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-
1. View this link


2. View this link

চর্যাপদ সংকলন-
1.View this link

ফেসবুক পেজ-
1.View this link

প্রচলিত আধুনিক  বাংলায় অনুবাদ-
1. View this link

2. View this link

ইংরেজী অনুবাদ-
1. View this link

---------------------------X-----------------------------

লেখাটি ২৭ই নভেম্বর, ২০১১ সালে প্রথম সমহোয়্যার ইন ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল।সামহোয়্যার ইন ব্লগে লেখাটির লেখাটির লিঙ্ক।

আজ একই সাথে ওয়ার্ড প্রেস ব্লগে প্রকাশিত 

No comments:

Post a Comment